BiographyHistory

উলুবাতলি হাসান

হাসান উলুবাতলি

ইতিহাসে অবহেলিত এক মহান যোদ্ধার ইতিকথা: ওসমানী তরুণ সুলতান মেহমদের সেনাপতিত্বে জীবনবাজি রেখে লক্ষ লক্ষ সেনা দৃপ্তপদে ইস্তানবুল বিজয়ে অংশ নেন। তাদের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে যে ক’জনের নাম যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখ থেকে মুখে, হৃদয় থেকে হৃদয় হয়ে আজ পর্যন্ত পৌঁছেছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন উলুবাতলি হাসান। আজও যার নাম শুনে তুর্কীর মানুষ প্রেরণা পায়।

১৪৫৩ সালের গোঁড়ার কথা। ওসমানী সালতানাতে বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। এবারের শত্রু সমকালীন অন্যতম পরাশক্তি বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য। যাদের বিরুদ্ধে সুলতান মেহমেদের পূর্বপুরুষরা দেড়শ বছর ধরে চেষ্টা করার পরও সফলতা অর্জন করতে পারেননি। তবে, এবারের একুশ বছরের সুলতান দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তিনি রাত-দিন নিরলসভাবে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সীমানা এবং শক্তি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। জানা যায়, মাত্র ছয় বছর বয়স থেকেই যখন অন্য বাচ্চারা পুতুলের ঘর সাজাতে ব্যস্ত থাকত তখন ছোট্ট মেহমেদের নিত্যকার কাজ ছিল ‘বাইজান্টাইনের দেয়াল’ আঁকিবুঁকি করা।

রাসুলুল্লাহ সাঃ এর বাণী :- বাইজান্টাইন তথা কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ’র সাঃ ভবিষ্যতবাণীটার সরল অনুবাদ করলে অর্থ দাঁড়ায়ঃ-

“কনস্টান্টিনোপল অবশ্যই বিজিত হবে( মুসলমানদের দ্বারা), এ বিজয়ের সেনাপতি কতই না সৌভাগ্যবান সেনাপতি, এবং এ বিজয়ের সেনাদল কতইনা সৌভাগ্যবান সেনাদল!’’ (ইমাম বোখারি রহঃ এর আত-তারিখুল কাবির, ইমাম আহমেদ ইবনে হাম্বল রহঃ এর মুসনাদে আহমদ’এ এবং তাবারি রহঃ এর আল-মুজমাউল কাবিরে এ হাদিসটি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে )

কনস্টান্টিনোপল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী। ক্রুশপূজারিদের স্বর্গরাজ্য। সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহের নেতৃত্বে উসমানি বাহিনী কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করে আছে। ৫৩ দিন গত হয়ে গেছে, কিন্তু কনস্টান্টিনোপল পতনের কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ, তখনকার সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত দুর্গপ্রাচীর ছিল কনস্টান্টিনোপলের দুর্গপ্রাচীর।

ক্রমবর্ধমান শক্তিধর উসমানি সাম্রাজ্যের হাত থেকে রক্ষা করতে ক্রুশপূজারিরা দুর্গপ্রাচীরকে খুবই মজবুত করে রেখেছে। ওসমানী সাম্রাজ্যে জুড়ে ঘোষণা দেয়া হল বাইজান্টাইনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে এবং আগ্রহীরা সেনাবাহিনীতে অংশ নিতে পারবেন। মাত্র ২৪ বছর বয়সী তরুণ উসমানি সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ কনস্টান্টিনোপল জয় করা ছাড়া সালতানাতের রাজধানী বুরসায় না ফিরে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প করেছেন।

সুলতানের আহবান এবং রাসুলুল্লাহ’র সাঃ ভবিষ্যৎবাণীর সেই মুসলিম সেনাদলে…
ভবিষ্যৎবাণীর সেই সৌভাগ্যবান সেনাপতি হয়ে নিজেকে ধন্য করার জন্য হাজার হাজার তরুণ-যুবা সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহণের ইচ্ছা পোষণ করেন। তাঁদের মধ্যে ওসমানী সাম্রাজ্যের প্রথম রাজধানী বুরসা’র “উলুবাতলি হাসান” ছিলেন অন্যতম। আল্লাহর পথে জিহাদ করে নিজের জীবনকে ধন্য করতে ছুটে এলেন সুলতান মেহমদের কাছে। যুক্ত হলেন মুসলিম সেনাদলে।

উলুবাতলি হাসানের জন্ম ও বংশ পরিচয় :

হাসান উলুবাতলির জন্ম ১৪২৮ সালে। তুরুস্কের বুরসা প্রদেশের অন্তর্গত কারাচাবের নিকটস্থ উলুবাত নামক গ্রামে। ২৫ বছর ছুঁই ছুঁই একজন তাগড়া নওজোয়ান। উসমানি সাম্রাজ্যের দুর্দান্ত ‘জানিসারি বাহিনী’র মারকুটে সাহসী, বীর সৈনিক। স্কটিশ ইতিহাসবিদ লর্ড কিনরোজের লেখা “দ্য অটোমান সেঞ্চুরিস” অনুযায়ী তিনি খুব দীর্ঘদেহী ব্যক্তি ছিলেন। “উলুবাতলি হাসান” নামের অর্থ “উলুবাতের হাসান”। কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের সময় তাঁর বীরোচিত ভূমিকার কারণে আজও তাকে বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়।

রণাঙ্গনে উলুবাতলি হাসান :-

২৯ মে ১৪৫৩, ফজর নামাজের আগে মুসলিম সৈন্যরা পরিচ্ছন্ন কাপড় পড়ে একে অপরের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। সুলতান মেহমেদের ইমামতিত্বে ফজরের নামাজ সম্পন্ন করে সেনারা নিজ নিজ স্থানে গিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ালেন। উলুবাতলি হাসানও সামনের কাতারে নিজের জায়গা করে নিলেন… এক হাতে তার মুসলিম সালতানাতের ঝাণ্ডা অপর হাতে ঢাল।

যুদ্ধ শুরু হয়েছে যুদ্ধের দামামা কনস্টান্টিনোপলের শক্ত প্রাচীর ভেদ করে শহরের ভেতর প্রভাব সৃষ্টি করে। উসমানিরা চুড়ান্ত আঘাত হানে। কিন্তু না; দেয়াল-পতনের কোনো নামগন্ধ নেই! খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও নাজুক সেই মুহূর্তে হাসান উলুবাতলি যুগান্তকারী একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। একাই দুর্গের প্রাচীরে চড়ে বসবেন বলে ঠিক করেন। যেই ভাবা, সেই কাজ। একটি তলোয়ার, একটি ছোট ঢাল এবং উসমানি পতাকা হাতে নিয়ে তিনি দুর্গপ্রাচীরের দিকে যাত্রা করেন। তার সাহসিকতায় সাহস পায় আরও ৩০ জন সৈন্য। তারা তাকে অনুসরণ করে। তার উদ্দেশ্য ছিল দুর্গপ্রাচীরে উসমানি ঝাণ্ডা উড্ডীন করা।

দুর্গপ্রাচীরের চারিদিকে তুমুল যুদ্ধ চলছে। তরবারির ঝনঝনানি আর শাঁ শাঁ করে আসা তীরবৃষ্টি উপেক্ষা করে দেয়ালের দিকে তীব্র বেগে অগ্রসর হতে থাকেন হাসান। তাঁর পিছু পিছু তার অনুসারীরা। একে একে তাদের ১৭ জন তীরের আঘাতে জমিনে লুটিয়ে পড়ে শহীদ হয়ে যান। কিন্তু তিনি ছুটে চলছেন, হঠাৎ একটি তীর এসে তাঁর গায়ে লাগে। তিনি এতে পিছপা হন নাই। যন্ত্রণা উপেক্ষা করে এগিয়ে যান।

এরপর মই বেয়ে প্রাচীরের উপর উঠতে থাকেন। আরো একটা তীর এসে লাগে তাঁর গায়ে। তিনি পড়তে পড়তে নিজেকে রক্ষা করেন। সব যাতনা সহ্য করে উপরে উঠতেই থাকেন। অবশেষে দুর্গেরপ্রাচীরে চড়ে বসেন এবং সেখানে উসমানী পতাকা উড্ডয়ন করেন। তখনও বৃষ্টির মতো তীর তার দিকে ধেয়ে আসছিল। তীরের আঘাতে আঘাতে তিনি ঝাঁঝরা হচ্ছিলেন।

তবুও নিজের শরীর দিয়ে পতাকা রক্ষা করে যেতে থাকলেন। ঠিক সেই সময় তার কাছে পৌঁছতে সক্ষম হয় তার অনুসারীদের মধ্য থেকে ১২ জন অনুসারী। তারা তাকে ঘিরে দাঁড়ায়। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না হাসান; ঢলে পড়লেন এবং সাথে সাথেই শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে নিলেন। তাকে পরখ করে দেখা যায়, ২৭টি তীর বিদ্ধ ছিল তার শরীরে! কনস্টান্টিনোপলের প্রাচীরে উসমানি পতাকা উড়তে দেখে, উসমানি সেনাদের মনোবল সাংঘাতিকভাবে বৃদ্ধি পায়।

চূড়ান্ত আঘাত হানার নির্দেশ দেন সুলতান। গগনবিদারী শব্দে ফেটে পড়তে শুরু করে উসমানীয় কামানগুলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রাচীরের দুর্বল অংশে ফাটল সৃষ্টি হয়। একসময় দেয়াল ধ্বসে পড়ে। সেই ফাটল দিয়ে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো উসমানি সেনারা ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করে। বিজিত হয় কনস্টান্টিনোপল। ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয় দেড়হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী রোমান সাম্রাজ্য ও তার সভ্যতা। আর সে জায়গা পূরণ করে নেয় ইসলাম। তখনই কনস্টান্টিনোপলের নাম পালটিয়ে রাখা হয় “ইসতাম্বুল”। মানে ইসলামের শহর। ইসলাম্বুল থেকে পরে ইস্তাম্বুল। Read More

-মুফতি সাজিদ মোল্লা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button