শহীদ আবু সাইদের জীবনী
শহীদ আবু সাইদের জীবনী
আবু সাইদ ছিলেন একজন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের সক্রিয়কর্মী। তিনি এই আন্দোলনের রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়ক ছিলেন। কোটা আন্দোলনকারীরা তাকে আন্দোলনের প্রথম শহীদ বলে আখ্যায়িত করেছে।
ব্যক্তিগত জীবন :
আবু সাঈদ ২০০১ সালে রংপুরের জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মকবুল হোসেন এবং মাতার নাম মনোয়ারা বেগম। আবু সাঈদের ছয় ভাই ও তিন বোন ছিলো, নয় ভাই বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। তিনি স্থানীয় জাফর পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপরে স্থানীয় খালাশপীর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাশ করেন। এরপর তিনি ২০১৮ সালে রংপুর সরকারি কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। পরে তিনি ২০২০ সালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন।তিনি রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।
২০২৪-এর কোটা সংস্কার আন্দোলন :
আবু সাঈদ ছিলেন ২০২৪ সালের বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের একজন কর্মী। ২০১৩ এবং ২০১৮ সালের পর ২০২৪ সালের ৬ জুন আবারো কোটা সংস্কারের আন্দোলন শুরু হয়। তিনি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক হিসাবে এই আন্দোলনে যোগদান করেন। তিনি রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ও রংপুর অঞ্চলে কোটা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। তিনি আন্দোলনকে বেগবান করতে ১৫ জুলাই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে নিহত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শামসুজ্জোহাকে উল্লেখ ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন।
“স্যার! (মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা), এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার স্যার! আপনার সমসাময়িক সময়ে যারা ছিলো সবাই তো মরে গিয়েছে। কিন্তু আপনি মরেও অমর। আপনার সমাধি আমাদের প্রেরণা। আপনার চেতনায় আমরা উদ্ভাসিত। আপনারাও প্রকৃতির নিয়মে একসময় মারা যাবেন। কিন্তু যতদিন বেচেঁ আছেন মেরুদণ্ড নিয়ে বাচুঁন। নায্য দাবিকে সমর্থন জানান, রাস্তায় নামুন, শিক্ষার্থীদের ঢাল হয়ে দাড়াঁন। প্রকৃত সম্মান এবং শ্রদ্ধা পাবেন। মৃত্যুর সাথে সাথেই কালের গর্ভে হারিয়ে যাবেন না। আজন্ম বেচেঁ থাকবেন শামসুজ্জোহা হয়ে। অন্তত একজন ‘শামসুজ্জোহা’ হয়ে মরে যাওয়াটা অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানের আর গর্বের”।
১৬ জুলাই দুপুর ১২টা থেকেই রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলে কোটা আন্দোলনকর্মীরা বিক্ষোভ করছিলো। আবু সাঈদ এই আন্দোলনের সম্মুখ ভাগেই অবস্থান করছিলো সবসময়।
মৃত্যুরসন্ধিক্ষণে:
১৬ জুলাই দুপুর ১২টা থেকেই রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলে কোটা আন্দোলনকর্মীরা বিক্ষোভ করছিলো। আবু সাঈদ এই আন্দোলনের সম্মুখ ভাগেই অবস্থান করছিলো সবসময়।১৬ জুলাই দুপুর আড়াইটা থেকে তিনটার দিকে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে কোটা সংস্কার শিক্ষার্থী ও পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এই ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে।
ছাত্রদের সবাই স্থান ত্যাগ করলেও আবু সাঈদ স্থান ত্যাগ করেনা। সে হাতে একটি লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। পুলিশ এই অবস্থায় তার উপরে গুলি ছুড়ে। সংঘর্ষ শুরু হলে আন্দোলনকারীদের মধ্যে সবার আগে ছিলেন আবু সাঈদ। অন্যরা একটু পেছনে ছিলেন। আবু সাঈদের ঠিক সামনে অবস্থান ছিল পুলিশের। পুলিশের অবস্থানের জায়গাটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে। উল্টো দিক থেকে রাবার বুলেট ছুড়ছিলেন পুলিশের সদস্যরা। তারপরও অবস্থান থেকে সরেননি আবু সাঈদ, দাঁড়িয়েই ছিলেন, তাঁর হাতে ছিল একটি লাঠি। তিনি সেই লাঠি দিয়ে রাবার বুলেট ঠেকানোর চেষ্টা করছিলেন।
একপর্যায়ে শরীরে একের পর রাবার বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আবু সাঈদ। হাসপাতালে আনার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে গত ১৬ জুলাই গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যু হয়। ওই দিন বেশ কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশের গুলি আবু সাঈদের বুকে লাগে। প্রত্যক্ষদর্শীসহ শিক্ষার্থীরাও অভিযোগ করেন, পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ নিহত হয়েছেন।
পুলিশ প্রসাশন যা বলেন এ ব্যাপারে :
মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণী বা এফআইআর-এ পুলিশ দাবি করেছে, আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়নি।
আবু সাঈদের মৃত্যুর পরদিন ১৭ জুলাই রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের তাজহাট থানায় এ ব্যাপারে একটি মামলা হয়। বাদী তাজহাট থানার (বেরোবি) পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই বিভূতি ভূষণ রায়। পেনাল কোডের (১৪৩/১৮/৬/৩৩২/ ৩৩৩/৩৫৩/৩৭৯/৪৩৫/ ৪২৭/৩০২/৩৪) ধারায় মামলাটি করা হয়।
মামলার বিবরণে উল্লেখ রয়েছে, বেআইনি জনতা সাধারণ/মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টি করে গুরুতর জখম, চুরি, ভাঙচুর, ক্ষতিসাধন, অগ্নিসংযোগ ও নিরীহ ছাত্রকে হত্যা করে অপরাধ করা হয়েছে।
মামলার বিবরণে আসামি হিসেবে কারও নাম উল্লেখ না থাকলেও এতে বলা হয়, এরা উচ্ছৃঙ্খল ২-৩ হাজার আন্দোলনকারী ছাত্র নামধারী দুর্বৃত্ত।
তাদের সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াত-শিবির সমর্থিত নেতাকর্মীও রয়েছে।
এতে আরও উল্লেখ রয়েছে, পুলিশ সদস্যদের মারপিট করে তাদের মারাত্মক আহত করে ও সড়ক অবরোধে থাকা উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রদের মধ্য হতে বেশ কিছু ছাত্রবেশী সুবিধাভোগী রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনরত দুর্বৃত্তগণ বিভিন্ন দিক থেকে বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেল ও তাদের নিকটে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র হতে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশও এপিসি গাড়ির মধ্য হতে কং/১১৮৬ সোহেল তার নামীয় সরকারী ইস্যুকৃত শর্টগান হইতে ১৬৯ রাউন্ড রাবার বুলেট ফায়ার করে।
পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিভিন্ন দিক থেকে আন্দোলনকারীদের ছোড়া গোলাগুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের একপর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীকে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখা যায়। তখন তার সহপাঠীরা তাকে ধরাধরি করে জরুরি চিকিৎসার জন্য বিকেল ৩টা ৫ মিনিটে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। মৃত ছাত্রের নাম আবু সাইদ।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা যা বলছেন
আবু সাইদ নিহতের ঘটনায় পুলিশ মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। মামলার বিবরণে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ মারা গেছেন— এমন কোনো তথ্যের উল্লেখ নেই। পুলিশের এই প্রতিবেদনকে সাজানো নাটক বলে অভিহিত করেছেন তারা। সাধারণ ছাত্ররা বলছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ মারা গেলেও এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সুস্পষ্ট মামলা হয়নি। উল্টো নিজেদের দোষ ঢেকে পুলিশ দায়ী করেছে আন্দোলনকারীদের।
শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন– প্রকাশ্যে বুকে গুলির যে ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সারা বিশ্ব দেখল, সেটি কি তাহলে মিথ্যা? তাছাড়া আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না, ভিডিও দেখলে তার প্রমাণ মিলবে।
এদিকে আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় যেসব ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল তাতে দেখা যায় তিনি দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছেন। আর উল্টো দিক থেকে পুলিশ শর্টগান থেকে গুলি ছুড়ছে। একপর্যায়ে আবু সাঈদ গুলিবিদ্ধ হলে অন্য শিক্ষার্থীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
যদিও এফআইআরে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন যে ‘বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন দিক থেকে গুলি ছুড়তে থাকে এবং ইটের টুকরো নিক্ষেপ করতে থাকে। একপর্যায়ে এক শিক্ষার্থীকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখা যায়।’বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশে অনীহা জানিয়ে বলেন, তাদের সামনে আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। তারা এখন এই হত্যা নিয়ে মিথ্যাচার করছে। ভুয়া ও বানোয়াট তথ্য ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে পুলিশ। আমরা পুলিশের সাজানো এ নাটক মানি না। এই মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই সাজানো মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবেন এমনটাও দাবি তাদের।
যা বলছেন শিক্ষকরা
আবু সাঈদকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, হাত, বুক, পিঠ, মুখসহ সাঈদের শরীরের শতাধিক স্থানে বুলেটের আঘাতের চিহ্ন ছিল। মাথার পেছনে ফুটো হয়ে রক্ত ঝরছিল। সাঈদের শরীর ঝাঁজরা করে দেওয়া সেই পুলিশের বিচার দাবি করে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে পুলিশের লুকোচুরির ঘটনা রহস্যজনক। পুলিশের সেই কর্মকর্তাকে কী শাস্তি দেওয়া হয়েছে, জনগণ তা জানতে চায়।
বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক তাবিউর রহমান প্রধান বলেন, আবু সাঈদ নিহতের ঘটনা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। অথচ এ ঘটনায় সুস্পষ্ট মামলা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও এ হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট মামলা করেনি। আমরা এতে হতাশ। আমরা ছাত্র হত্যার বিচার চাই। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মতিউর রহমানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে কমিটিকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু তারাও এখন পর্যন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। কমিটির প্রধান বলেন, তদন্ত চলমান, শিগগিরই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
রংপুর পার্ক মোড়ের নাম ‘শহীদ আবু সাঈদ চত্বর’ দিলেন শিক্ষার্থীরা
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের এক দফা দাবির আন্দোলনে উত্তাল পুরো দেশ। মঙ্গলবার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে ৬ জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে পুলিশের গুলিতে নিহত কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয় কমিটির সদস্য ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদের স্মরণে রংপুর পার্ক মোড়ের নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ আবু সাঈদ চত্বর’ নামকরণ করার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।এদিকে এদিন সকালের পর থেকে বর্তমানে গুগল ম্যাপের পার্ক মোড়ের জায়গায় শহীদ আবু সাঈদ চত্বর নাম দেখা যাচ্ছে।
ফেসবুকে ওবায়দুর রহমান নামের একজন লিখেছেন, ‘এরইমধ্যে গুগল ম্যাপে পার্ক মোড়ের নাম পরিবর্তন করে শহীদ আবু সাইদ চত্বর নাম করা হয়েছে। এখন বাকিটুকু আপনাদের। তাকে সম্মান করে তার নামে এই চত্বরকে ডাকবেন নাকি অন্য নামে!’ আরেক শিক্ষার্থী ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘আজ থেকে রংপুর পার্ক মোড়ের নাম শহীদ আবু সাঈদ চত্বর- সাধারণ শিক্ষার্থী।’
-লেখক সাজিদুর রহমান