BiographyHistoryখোলা কলাম

সেলজুক বেগ

সেলজুক বেগের ইতিকথা

সেলজুক বেগ। তিনি ছিলেন একটি ওঘুজ তুর্কী বসতির সেনাপতি, এবং সেলজুক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। সেলজুক সাম্রাজ্যের ইতিহাসে অকুতোভয় বীর সেনানী সেলজুক বেগের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে এবং থাকবে। তার বীরত্ব আর রাজনৈতিক দুরদর্শিতার কারণে ক্ষুদ্র যাযাবর গোত্রটি একসময় পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকের পরিমান নিজেদের শাসনের আয়ত্তে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল।

সেলজুক বেগের জন্ম ও বংশপরিচয়

সেলজুক বেগের জন্ম তারিখ জানা যায়নি। তবে তিনি ছিলেন তাকাক বা তুকাক এর সন্তান। যার উপাধী ছিল তৈমুর ইয়ালিগ যার অর্থ “লোহার ধনুক”। তিনি তার কর্মদক্ষতা আর সাহসীকতার জন্যই এমন উপাধি লাভ করেছিলেন। ওঘুজ সংস্কৃতিতে তীর এবং ধনুককে সার্বভৌমত্বের লক্ষণ হিসাবে বিবেচনা করা হতো।

আর তাই সেলজুক বেগের পিতার ডাকনাম বিবেচনা করে বুঝা যায় তিনি কোনও সাধারণ সৈনিক ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন একজন সেনাকমান্ডার বা সেনাবাহিনীর প্রধান। তিনি ছিলেন ওগুজ কাইনিক গোত্রের গুত্রপতি। বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, তাকাক বা তুকাক একজন শক্তিশালী রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন এবং ওঘুজ ইয়াবগু রাজ্যে প্রচুর শক্তি ও প্রভাবের অধিকারী ছিলেন। ধারনা করা হয় যে ৯২৪ সালের দিকে তিনি ইন্তেকাল করেন। সেলজুক বেগ এর সন্তান ও তাদের নামকরন

সেলজুক বেগ এর সন্তান ও তাদের নামকরন

এক বর্ননায় পাওয়া যায়, সেলজুক বেগের মোট চারজন পুত্রসন্তান ছিল। তার চার পুত্রের নাম- মিকাইল বেগ (মিকাইল বেগ পরবির্তীতে তিনি গুত্রপতি হয়েছিলেন), ইস্রাইল (পিগু আরসালান), মুসা এবং ইউনুস। আরেক বর্ণনায় পাওয়া যায়, সেলজুক বেগের মোট পাঁচজন পুত্রসন্তান ছিল। তার পাঁচ পুত্রের নাম- মিকাইল বেগ (মিকাইল বেগ পরবির্তীতে গুত্রপতি হয়েছিলেন), ইস্রাইল (পিগু আরসালান), মুসা, ইউনুস এবং ইউসুফ। এই নামগুলো খাজার ইহুদী বা নেস্টেরিয়ান খ্রিস্টধর্মের পূর্বের পরিচিত ব্যক্তিদের নাম থেকে নেওয়া হয়।

এই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটেছিল। আর সেটি হচ্ছে সেলজুক বেগের বড় ছেলে মিকাইলের মৃত্যু। মিকাইলের দুই সন্তান ছিল। তুঘ্রীল বেগ ও চাগরী বেগ। তারাই পরবর্তীতে সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করছিলেন। এই ঘটনার পরে, মিকাইলের স্ত্রী তুঘ্রীল বেগ এবং চাগরী বেগ এর মা সেলজুকের অন্য ছেলে ইউসুফকে বিয়ে করেছিলেন। পুরাতন তুর্কি ঐতিহ্য অনুসারে মিকাইল ইবনে সেলজুকের দুই পুত্র তুঘ্রীল এবং চাগরী তাদের দাদা সেলজুক বেগের কাছেই লালিত-পালিত হতে থাকে।

সেলজুক বেগের জেন্ডে স্থানান্তর

পিতা তাকাক বা তুকাকের মৃত্যুর পর সেলজুক বেগ ক্ষমতার মসনদে আসীন হন। সেলজুক বেগ ছিলেন অন্যান্য গোত্রপতি থেকে একটু ভিন্ন। অসীম সাহসিকতা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে ঐ অঞ্চলে বসবাসরত অন্যান্য গোত্রের লোকেরাও তাকে অনেক সম্মান করতো। কোনো এক অজানা কারণে সেলজুক বেগের সাথে ওঘুজ ইয়াবগুদের সম্পর্কের একটি টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়।

তখন পরিস্থিতি আরো অবনতি হলে ৯৮৫ সালে সেলজুক গোত্র আরল এবং ক্যাস্পিয়ান সমুদ্রের মাঝামাঝি বিশাল আয়তনের এলাকায় টুকুজা-ওগুজের কয়েকটি গোত্রের সঙ্গমৈত্রি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। বর্তমান দক্ষিণ-মধ্য কাজাখস্তানের নিম্নতর আমু-দরিয়ার (জ্যাকসেটস) ডানদিকের তীরে তারা তাবু স্থাপন করে যা জেন্ডের অভিমুখে। এটা কিজেল অড়ডার কাছাকাছি।

ধারনা করা হয় যে এই হিজরতের সময় সেলজুক বেগের সাথে ১০০ জন ঘোড়সওয়ার, ১৫০০ উট এবং ৫০,০০০ ভেড়া ছিল? প্রতিটি ঘোড়সওয়ার যদি একটি পরিবারের সমতুল্য হন, সেলজুকরা যারা জেন্ডে চলে এসেছিলেন তারা সম্ভবত প্রায় ৫০০-৭০০ জন লোকের একটি ছোট যাযাবর সম্প্রদায় ছিলেন।

সেলজুক বেগ এর ইসলাম গ্রহন

সেলজুক বেগের গোত্রের নতুন অঞ্চলে স্থানান্তরিত হওয়া আগেও তারা মুসলিম ছিলো না। তখন তারা ইহুদী বা নেস্টেরিয়ান খ্রিস্টধর্মের অনুসারী ছিলো বলে ধারণা করা হয়। দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত জেন্ড একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জাঁকজমকপূর্ণ সীমান্তবর্তী শহর রুপে পরিগনিত হতো। সেখানের চারণভূমিগুলোতে বিভিন্ন যাযাবর গোত্র বসবাস করতে দেখা যেত। শহরটিতে তখনকার সময়ের মুসলিম বনিক এবং ধর্মপ্রচারকদের আনাগোনা ছিলো। আর সেই সুবাদেই সেলজুকরা জেন্ডে এসে ইসলামকে দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করেন। এটি ঘটেছিল ৯৮৫ সালে।

মালিক আল গাজি উপাধিতে সেলজুক বেগঃ

ইসলাম গ্রহণের পরে সেলজুক বেগ ওঘুজ ইয়াবগু কর্তৃক বার্ষিক কর আদায়ের জন্য জেন্ডে প্রেরিত কর্মকর্তাদের কর প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন, “মুসলমানরা কাফেরদের কখনো কর দিবে না”। এর ফলে অমুসলিম তুর্কীদের সাথে সেলজুক বেগ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ইসলামে প্রবেশ করার পর বীরত্বের সাথে অমুসলিম তুর্কীদের সাথে লড়াই করে যান। তার বীরত্বের জন্য তাকে মালিক আল গাজি উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

সেলজুক বেগ এর রাজনৈতিক মতাদর্শঃ

কিছু সূত্রে জানা যায়, সেলজুক বেগ সেনাবাহিনীতে একজন সাধারণ সেনানায়ক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং আস্তে আস্তে নিজের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি দেখাতে সক্ষম হন। জেন্ড এবং এর আশেপাশের যুদ্ধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জনকারী সেলজুক বেগ ধীরে ধীরে ট্রান্সঅক্সানিয়া’র রাজনৈতিক ইভেন্টে প্রবেশ করতে শুরু করেছিলেন।

এ সময় কারা-খানিদের শাসক হাসান বিন সুলায়মান বুঘরা খান সামানী সাম্রাজ্যের শহর বুখারা দখল করেছিলেন। সামানি সাম্রাজ্য তখন সেলজুক বেগ কে বুঘরা খানের বিরুদ্ধে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। এর প্রেক্ষিতে পরে, সেলজুক বেগ তার ছেলে পিগু আরসলানকে (ইস্রাইল) কে ট্রান্সঅক্সানিয়াতে প্রেরণ করেছিলেন সামানীদের সাহায্য করার জন্য।

পুত্র আরসলানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরঃ

যেহেতু সেলজুক বেগ ধীরে ধীরে বুড়ো হয়ে যাচ্ছিল, তাই তিনি প্রশাসনিক কাজকর্ম তাঁর বড় ছেলে পিগু আরসলান (ইস্রাইল) এর হাতে তুলে দেন। এরই মধ্যে সামানী সাম্রাজ্য, যা তার ক্ষমতা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছিল তারা কারা-খানিদদের দ্বারা বারবার আক্রমণ এর শিকার হয়েছিল এবং প্রতিবারই সেলজুকরা তাদের সাহায্য করেছিল। এভাবে সেলজুক বেগের সন্তান পিগু আরসলানকে তিনি সামরিক দক্ষতা প্রমাণের সুযোগ দিয়েছিলেন।

ফিরিক, আবির আল মিসকার এবং বেক-টার্জিনের অভ্যন্তরীণ অশান্তির দ্বারা যখন সামানী সাম্রাজ্যের ভীত কাঁপছিল তখনই কারা-খানিদরা যারা ট্রান্সঅক্সানিয়াতে প্রবেশ করেছিলেন এবং দ্বিতীয়বার বোখারা দখল করেছিলেন। তারা এবার সামানী সাম্রাজ্যে চুড়ান্ত আক্রমণ করে বসেন।

আরসলানের অধীনে সেলজুক বাহিনী সামানী রাজবংশের সর্বশেষ সদস্য আবু সালাম আল মুনতাসিরকে সামরিক সহায়তা দিয়েছিলেন। যদিও সেলজুকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সমর্থন পেয়ে ইলিগ খান নসরের নেতৃত্বে আল মুনতাসির কারা-খানিদ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কিছুটা সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তবে তিনি সামানী সাম্রাজ্যের পতন রোধ করতে পারেননি।

এই ঘটনার পরে, পুরো ট্রান্সঅক্সানিয়া কারা-খানিদ প্রশাসনের অধীনে আসে। পরে সেলজুকরা কারা-খানিদ সাম্রাজ্যের আনুগত্য স্বীকার করে।

সেলজুক বেগ এর মৃত্যুঃ

সেলজুক বেগ প্রায় আশি বছর বয়সে জাণ্ডে মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স ৮০ বছর সম্পর্কে একই মতামত পাওয়া গেলেও তার মৃত্যু সাল নিয়ে (১০৩৮ ও ১০৩৯) এই দুইটি মতামত পাওয়া যায়। সেই হিসাবে আমরা (১০৩৮-৮০-৯৫৮) দুইটি মতামত অনুযায়ী ৯৫৮ বা ৯৫৯ খ্রিস্টাব্দকে সেলজুক বেগ এর জন্ম সাল হিসাব পারি।

তাঁর মৃত্যুর পরে, তাঁর তিন বেঁচে থাকা পুত্রের মধ্যে পিগু আরসলান (ইস্রাইল) পুরাতন ওঘুজ ঐতিহ্য অনুযায়ী পূর্ণ প্রশাসনিক দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। এদিকে, মিকাইলের ছেলেরা তুঘ্রীল এবং চাগরী ১৪-১৫ বছর বয়সে প্রশাসনে “বেগ” হিসাবে স্থান লাভ করেন। যদিও পিগু আরসলান ইয়াবগু পরিবারের প্রধান ছিলেন, তবুও সেলজুকের ছেলেরা এবং নাতি নাতনিরা তুর্কমান বেগ এবং তাদের সাথে যুক্ত অন্যান্য বাহিনীকে পুরানো ওঘুজ ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আধা-সংযুক্ত পদ্ধতিতে শাসন করেছিলেন।

পরিশেষে সেলজুক সাম্রাজ্যের ইতিহাসে অকুতোভয় বীর সেনানী সেলজুক বেগের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে এবং থাকবে। তার বীরত্ব আর রাজনৈতিক দুরদর্শিতার কারণে ক্ষুদ্র যাযাবর গোত্রটি একসময় পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকের পরিমান নিজেদের শাসনের আয়ত্তে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button