সুলতান মেহমেদ কি তার ভাইকে হত্যা করেছিল?
হত্যার অভিযুক্তে সুলতান মেহমেদ
সুলতান মুহাম্মদ খান আল-ফাতিহ (রহঃ) কি সত্যিই ওনার ছোট ভাইকে হত্যা করেছিলেন??
আমরা জানার চেষ্টা করব ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে আসল ঘটনাটা কি হয়েছিল—
উসমানিয় সাম্রাজ্যের সপ্তম সুলতান মুহাম্মদ খান আল ফাতিহ ওনার বাবার ইন্তেকালের সময় মাইনর এশিয়ায় ছিলেন৷ তিনি দানিয়াল সাগর পাড়ি দিয়ে এডির্ন/অ্যান্ড্রিয়ানোপল পৌঁছান এবং শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন৷ যেহেতু বাবার জীবদ্দশায় তিনি দুই দুইবার ক্ষমতায় বসে ছিলেন কিন্তু দুইবারই ব্যর্থ হয়েছেন৷
এজন্য জনসাধারণের মধ্যে একটা গুঞ্জন ছিল তিনি একজন দুর্বল শাসক হিসেবে প্রমাণিত হবেন৷ সেনাবাহিনীর অফিসাররা তাঁর উপর চাপ প্রয়োগ করে তাদের ক্ষমতা বাড়াতে চাচ্ছিলেন৷ তাছাড়া তাঁকে অযোগ্য মনে করে বিভিন্ন কথাবার্তা জোরেশোরে ছড়িয়ে পড়ে৷ এর ফল হলো, সুলতান সম্পর্কে নানা কল্পকাহিনীর জন্ম নেয় যা একসময় পশ্চিমা ইতিহাসের অংশ হিসেবে প্রসিদ্ধি পায়৷
এরপর তা আমাদের ইতিহাসেও উদ্ধৃত হতে থাকে৷ এই কল্পকাহিনী মোতাবেক সুলতান মুহাম্মদ খান আল ফাতিহ ক্ষমতায় বসার পরপর নিজের একজন শিশু বয়সী ভাই আহমদ চিলপিকে হত্যা করেন যার মা ছিলেন সার্বিয়ার শাহাজাদি৷ এই হত্যাকাণ্ডও ছিল ওই সময় যখন শিশুটির মা অর্থাৎ সার্বিয়ার শাহজাদি সুলতান ক্ষমতায় বসায় তাকে মোবারকবাদ জানানোর জন্য আসছিলেন৷ এ সময় সুলতানের নির্দেশে তার একজন অফিসার নিষ্পাপ শিশুটিকে হত্যা করতে যান৷ তখন শিশুটির ধাত্রী তাকে গোসল করাচ্ছিলেন৷ সেই অফিসার ধাত্রীর হাত থেকে শিশুটিকে ছিনিয়ে নিয়ে হাউজে ডুবিয়ে হত্যা করেন৷
ঐতিহাসিকরা এ ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে এই ব্যাখ্যাও করেন যে, এর মধ্য দিয়ে সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ ক্ষমতার সুরক্ষা এবং সম্ভাব্য বিদ্রোহ দমনের জন্য নিছক সন্দেহের বশবর্তী হয়ে ভাইকে হত্যার প্রথা চালু করেন ৷ বরং এটা বলা হয় সুলতান রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য নিজের ভাইকে হত্যা করার আইন হিসেবে রাজ দরবারের অধিকারগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন৷
মূলত এই ঘটনা বিশ্বাস করার অনিবার্য প্রভাব হলো সুলতান মুহাম্মদ খান আল ফাতিহকে এমন ভয়ংকর অপরাধী মনে হবে যার পক্ষে বলার মতো কোনো উপায় থাকবে না এ কারণেই ঐতিহাসিকরা ঘটনাটি অত্যন্ত আফসোসের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন কিন্তু এই ঘটনাটি কি প্রমাণিত এ ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের দুইটি শ্রেণি রয়েছে- নিচে তাদের অভিমত উল্লেখ করা হলো—
একটি শ্রেণীর মতেঃ- এই ঘটনার কিছু বাস্তবতা আছে৷ তবে যেভাবে ঘটনা প্রসিদ্ধ লাভ করেছে সেটা বাস্তবতার পরিপন্থী৷
আরেকটি শ্রেণীর মতেঃ এই ঘটনা নিছক মনগড়া সুলতান মোহাম্মদ খান ফাতিহ ক্ষমতায় বসার পর তার ছোট ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছিল —
★এই সম্ভাবনাকে স্বীকার করে প্রথম শ্রেণীর ঐতিহাসিকরা এখানে দুটি ব্যাখ্যা পেশ করেন৷
(১) প্রথম ব্যাখ্যা হল : বাদশা দ্বিতীয় মুরাদের আট মাস বয়সী একটি ছেলে ছিল যার মা ছিলেন সার্বিয়ার শাহাজাদি৷ জেনেসারীর কোনো কোনো অফিসারের ধারণা ছিল এই শিশু ভবিষ্যতে মায়ের প্ররোচনায় বিদ্রোহ করতে পারে৷ এজন্য দ্বিতীয় মুহাম্মদ খান ক্ষমতায় বসার অনুষ্ঠানিকতার সময় জেনিসারি বাহিনীর কোন অফিসার থাকে হত্যা করেন৷ তিনি নিজের পক্ষ থেকে এই কাজ করে বাদশার নৈকট্য এবং বড় পদ পাওয়ার প্রত্যাশা করছিলেন ৷
ওই যুগে জেনিসারি অফিসাররা এত বেশি কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছিল যে, অনেক সময় নিজেরা কোন কাজ করে ফেলতো যার দায়ভার বর্তাতো শাসকের উপর৷ এটিও এমনই একটি কাজ৷ মোটকথাঃ- সুলতান মুহাম্মদ খান আল ফাতিহ এই কাজে প্রচন্ড অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন৷ এই কাজে জড়িত অফিসারের প্রতি কোন করুণা না দেখিয়ে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দেন৷ ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা এই ঘটনাকে এভাবে উল্লেখ করেছেন যেন সবকিছু সুলতানের নির্দেশেই হয়েছে৷ অথচ এমনটা হলে মৃত্যুদণ্ডের আগেই অফিসার সুলতানের নাম বলতেন৷
এটা উল্লেখযোগ্য যে, নিহত শাহজাদার মা সার্বিয়ার শাহজাদি মোহাম্মদ খান ক্ষমতায় বসায় তাকে মোবারকবাদ জানাতে আসছিলেন৷ এই হত্যাকাণ্ড যদি মুহাম্মদ খান ফাতেহীর নির্দেশে হতো তাহলে তো শাহাজাদি তার মুখ দেখতে চাইতেন না৷ এছাড়া একজন দুধের শিশু ভাইয়ের প্রতি সুলতান মুহাম্মদ খান ফাতিহের কি আশঙ্কা থাকতে পারে৷
(২) দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হলো: শিশুটির ধাত্রী তাকে হাউজের পাশে নিয়ে গোসল করাচ্ছিলেন৷ হঠাৎ তাকে কোন জরুরী কাজে একটু দূরে যেতে হয়৷ এদিকে এসে শিশুটি হাউসে পড়ে মারা যায়৷ সেখান থেকে উঠানোর আগেই তার মৃত্যু হয়৷ ওই সময় জেনিসারি অফিসার আলি বেগ এমন কিছু অপারাধ করে বসেন যার কারণে তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়৷ এতে জনসাধারণের মধ্যে এ কথা ছড়িয়ে পড়ে অথবা বিরোধীপক্ষ ইচ্ছে করে এটা ছড়িয়ে দেয়, যে দুধের শিশু ভাইকে সুলতান নিজে হত্যা করিয়েছেন৷
আর আলি বেগকে এজন্য সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কারণ তার হাতেই শিশুটি মারা যায়৷ নিজের বিরুদ্ধে প্রমাণ মুছে ফেলার জন্য মূলত সুলতান আলি বেগ কে মৃত্যুদণ্ড দেন ৷ নিছক একটি কল্পকাহিনী এভাবে ছড়িয়ে তা ইতিহাসের অধ্যায় হয়ে যায় অথচ বাস্তবতার সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র নেই।
★২য় শ্রেনীর ব্যাখ্যাঃ-
অপরদিকে তুর্কিদের ইতিহাসের উপর গবেষণা করা কেউ কেউ এই ঘটনাকে ভিত্তিহীন বলে আখ্যায়িত করেছেন৷ যাদের মধ্যে ড. মুহাম্মদ সালিম রাশেদির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য৷ তিনি এই বিষয়ে সনদ ও মতন সহ বিশেষ ইলমি /দালিলিক আঙ্গিকে আলোচনা করেছেন তিনি লেখেন—
‘ হেমার এই বর্ণনা ঐতিহাসিক দুকাসের কাছ থেকে উল্লেখ করেছেন৷ আর পরবর্তী সময়ে আসা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকরা এটাকে সেভাবেই বর্ণনা করেছেন৷ এভাবে এই ঘটনাটি যেন গবেষণার ঊর্ধ্বে উঠে যায়৷ অথচ বাস্তবতা হলো, সুলতান নিজের শিশু ভাইকে হত্যা করেছেন এটা ভিত্তিহীন ঘটনা বাস্তবে যার কোনো সুত্র নেই৷
এরপর বিশিষ্ট এই ঐতিহাসিক আরো লেখেন— সুলতান মুহাম্মদের উপর আরোপিত এই ঘটনার যদি নূন্যতম সত্যতা থাকতো তাহলে ফরাসি ঐতিহাসিক ফ্রাঞ্জস অবশ্যই তা উল্লেখ করতেন যিনি কনস্টান্টিনোপলের কায়সারের ঘনিষ্ঠ সহচর ও বন্ধু ছিলেন৷ তিনি একাধিকবার কায়সার ও উসমানি সাম্রাজ্যের মধ্যকার দূতিয়ালীর দায়িত্ব আঞ্জাম দেন৷ তিনি রোমান অন্যান্য ঐতিহাসিক এর তুলনায় বেশি কাছের সাক্ষী ছিলেন৷ এই ঘটনা বর্ণনা করা এবং ব্যাপকভাবে প্রচার করার বেশি অধিকার ছিল ফ্রাঞ্জসের ৷
কারণ তিনি সুলতানের সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করতেন৷ সুলতানের প্রতি তার ছিল প্রচন্ড ঘৃণা ৷ তিনি সুলতানের আলোচনা করতেন এবং তার ব্যাপারে এ ধরনের বিষয়াদি ছড়ানোতে পারদর্শী ছিলেন ৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি সুলতানের সঙ্গে জড়ানো এই ঘটনা উল্লেখ করেননি ; বরং তিনি তারাবজুনের বাদশার আলোচনা করতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে স্পষ্ট করে লিখেছেন, যখন সুলতান মুহাম্মদ খান আল ফাতিহ ক্ষমতায় বসলেন তখন তার কোন ভাই ছিলই না৷
এই ফরাসি ঐতিহাসিক মনে প্রাণে চাইতেন সুলতান মোহাম্মদ খান ফাতিহ যদি মারা গিয়ে তার বাবার সঙ্গে মিলিত হতেন তাহলে উসমানি সালতানাত কোন উত্তরাধিকারী ছাড়া বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতির শিকার হতো এবং এটি ক্ষমতার লড়াইয়ের উর্বর ক্ষেত্র হতো৷
এরপর তিনি লেখেন—‘ সুলতান মোহাম্মদ খান আল- ফাতিহের চার ভাই ছিলেন, যাদের সবাই বাবা দ্বিতীয় মুরাদের জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন৷ এজন্য প্রাচ্যবিদ মোরগাদসন এই উসমানি সালতানাতের আলোচনায় ‘যারা তাদের ভাইয়ের হত্যা করেছেন’ এই অধ্যায়ের সুলতান মুহাম্মদ খান ফাতিহের কোন আলোচনা করেননি৷ সুতরাং নিজের দুগ্ধপোষ্য শিশু ভাইকে হত্যার যে অভিযোগ সুলতান মুহাম্মদ খান ফাতিহের উপর আরোপ করা হয় এটি নিছক মনগড়া বর্ণনা যা ঐতিহাসিক ডুকাস নিজ থেকে বানিয়েছেন৷
আর তার থেকে অস্ট্রিয়ার ঐতিহাসিক হেমার তা বর্ণনা করেছেন৷ এরপর পরবর্তী সময়ের ঐতিহাসিকরা যাচাই- বাছাই ছাড়াই বর্ণনা করে আসছেন৷ এভাবে বর্ণনা হওয়া এবং ছড়িয়ে পড়ার কারণে এটি বিশুদ্ধ বর্ণনার মতো হয়ে গেছে৷ অথচ এর সঙ্গে বাস্তবতার কিংবা সত্যতার সামান্যতম কোন সম্পর্ক নেই৷
এই বিবরণের পর ডক্টর মুহাম্মদ সালিম রাশেদ বলেন:- কোন কোন প্রাচ্যবিদ উল্লেখিত ঘটনার সঙ্গে আরো কিছু নমগড়া কাহিনী যুক্ত করেন৷ যেমন গিবন এটা যুক্ত করেন যে, সুলতান তার কয়েকজন ভাইকে হত্যা করেন৷ কোন কোন প্রাচ্যবিদ এর উপর এই টিকাও যুক্ত করে দিয়েছেন যে, তাদের মধ্য থেকে এক ভাই প্রাণের রক্ষা পেয়ে ইউরোপে চলে যান এবং খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে ‘এলিস্টার উসমানি’ নামে প্রসিদ্ধ লাভ করেন৷
কিং ফ্রেডরিক তাকে অস্ট্রিয়ার একটি জায়গির দেন৷ সেখানে একজন শাহাজাদি তার প্রেমে পড়েন৷ যখন শাহাজাদা মারা যান তখন ওই শাহাজাদা এই শোকে বৈরাগ্য জীবন অবলম্বন করেন৷ এই সবগুলো মনগড়া কল্পকাহিনী৷ যখন প্রকৃত ঘটনাটি কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই তখন তাকে সংযুক্তি এবং এটা নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সুযোগ কোথায়!
হে প্রিয় ইতিহাস পাঠকরা আপনাদের বিবেক দিয়ে একবার চিন্তা করে দেখুন, কোনভাবেই আমরা এটা বলতে পারি না যে উসমানিয় অনেক শাহজাদাদেরকেই তো সাম্রাজ্যের গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচানোর জন্য হত্যা করা হয়েছে৷
হ্যাঁ এটা সত্য কিন্তু সে কথা টেনে আমরা সুলতান মোহাম্মদ খান আল ফাতিহ (রহঃ) এর মত ন্যায়পরায়ন, প্রচন্ড দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী ও অভাবনীয় সমরনীতির উদ্ভাবক, একাধিক ভাষায় পারদর্শী ও সমসাময়িক শ্রেষ্ঠ আলেমদের একজন যিনি কি না শরীয়তের হুকুম পরিপূর্ণভাবে পালন করতেন ৷
এমনকি যার চরিত্র সম্পর্কে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুসংবাদ দিয়েছেন৷ তাঁর ব্যাপারে আমরা কিভাবে এরকম জঘন্য ধরনের অপবাদ বিশ্বাস করতে পারি৷ তাই কোন মুসলিম শাসকদের ব্যাপারে মন্দ কথা ও অভিযোগ এবং তাদের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে অবশ্যই আপনারা মুসলিম ঐতিহাসিকদের গ্রহণযোগ্য গ্রন্থগুলো যাচাই করে নিবেন ৷ তাহলে আর ভুলের মধ্যে পড়তে হবে না Read More History
সংগ্রহে- সাজিদুর রহমান জামালী।