মীর মুগ্ধর জীবনী
মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ ছিলেন একজন বাংলাদেশী শিক্ষার্থী এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। তিনি আন্দোলনের সময় খাবার পানি এবং বিস্কুট বিতরণ করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। মুগ্ধর মৃত্যু কোটা সংস্কার আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে।
জন্ম ও ব্যাক্তিগত পরিচয়
মুগ্ধর বাবার নাম মীর মোস্তাফিজুর রহমান, মায়ের নাম শাহানা চৌধুরী।তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিন ভাইয়ের মধ্যে মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ ও মুগ্ধ ছিলেন যমজ।
মুগ্ধ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২৩ সালে গণিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ঢাকা শহরে অবস্থিত বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) প্রফেশনাল এমবিএ করছিলেন। মৃত্যুর সময়ও তার গলায় বিইউপি আইডি কার্ডটি রক্তমাখা অবস্থায় ছিল।
তিনি একজন ফ্রিল্যান্সার ছিলেন। মৃত্যু পর্যন্ত ফাইভারে তার এক হাজারের অধিক কাজ সম্পন্ন করেছেন।ফ্রিল্যান্সিং এর পাশাপশি তিনি একজন ভ্রমণপিপাসু , ভালো ফুটবলার এবং বাংলাদেশ স্কাউটের একজন সদস্য ছিলেন।মুগ্ধর কাজের প্রশংসা করে ফাইভার বুধবার জুলাই) সন্ধ্যায় তার শোক প্রকাশ করে। মীর মুগ্ধর জীবনী
মুগ্ধ একজন জিনিয়াস স্টুডেন্ট
মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। সেখান থেকে গণিত বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করে গত মার্চে ঢাকায় আসেন তিনি। এরপর গত মার্চে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) এমবিএতে ভর্তি হন। মৃত্যুর সময়ও তার গলায় বিইউপি আইডি কার্ডটি রক্তমাখা অবস্থায় ছিল।
পানি লাগবে কারো, পানি, পানি?
গত ১৮ জুলাই রাজধানীর উত্তরা আজমপুর এলাকায় মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ যখন পানির কেস হাতে নিয়ে ক্লান্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে পানি বিতরণ করছিলেন, তখন তিনি ঠিক মতো তাকাতেও পারছিলেন না। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশের ছোড়া টিয়ারগ্যাসে তার চোখ হয়তো জ্বালা করছিল।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুগ্ধর যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধর শেয়ার করা এক ভিডিওতে দেখা যায় সেদিন অকুতোভয় মুগ্ধ কীভাবে সেবা দিয়ে চলেছেন অন্য শিক্ষার্থীদের।
ভিডিওটা যে সময়ে করা হয়, তার মাত্র ১৫ মিনিট পর থেকেই তিনি আর কাউকে পানি দেননি, দিতে পারেননি। আন্দোলনকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি চালালে একটি গুলি মুগ্ধর কপালে লাগে।
তার সঙ্গে থাকা বন্ধুরা দ্রুত মুগ্ধকে ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান তিনি। ফেসবুকে প্রোফাইল ছবির ক্যাপশনে মুগ্ধ যা লিখেছিলেন, তার বাংলা অনেকটা এমন—জীবন অর্থবহ হোক, দীর্ঘ নয়।
সত্যিই এক অর্থবহ জীবনযাপন করে গেলেন মুগ্ধ। তার বড় ভাই মীর মাহমুদুর রহমান দীপ্ত জানান, মুগ্ধ ১৮ জুলাই আন্দোলনে যোগ দেন এবং সেখানে শিক্ষার্থীদের নানাভাবে সহায়তা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার্থীরা ন্যায়সঙ্গত লড়াই করছে। ছোটবেলা থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব মুগ্ধ।
তিনি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্কাউট গ্রুপের একজন রোভার স্কাউট এবং ইউনিট লিডার ছিলেন। ২০১৯ সালে বনানী অগ্নিকাণ্ডের সময় উদ্ধার অভিযানে অংশগ্রহণ ও সাহসী ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ স্কাউটস থেকে ‘ন্যাশনাল সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করেন মুগ্ধ। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে গত মার্চে এমবিএ করতে মুগ্ধ ভর্তি হয়েছিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে।
স্নিগ্ধকে ফেলে গেলেন মুগ্ধ :
চলমান আন্দোলনের শুরুর দিকে মুগ্ধর পরিবার ছুটি কাটাতে যায় কক্সবাজারে। কিন্তু, মুগ্ধ ও তার যমজ ভাই স্নিগ্ধ থেকে যান ঢাকাতেই। মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একসঙ্গেই স্কুলে গিয়েছেন। তাদের বন্ধুও ছিল অভিন্ন। মুগ্ধর মৃত্যুর পর থেকেই ট্রমায় আছেন স্নিগ্ধ।
দ্য ডেইলি স্টার থেকে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্লিজ, আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন।’ তাদের বড় ভাই দীপ্ত বলেন, ‘স্নিগ্ধ একেবারেই নিস্তেজ হয়ে গেছে।’ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে স্নিগ্ধই প্রথম দেখেছিলেন মুগ্ধর মরদেহ।দীপ্ত বলেন, ‘স্নিগ্ধর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি স্মৃতি মুগ্ধর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সে শুধু ভাই হারায়নি, হারিয়েছে নিজের জীবনের একটা অংশ।’
দীপ্ত জানান, ১৮ জুলাই সকালে পরিবার নিয়ে কক্সবাজারে যান তারা। ‘আমার মা কখনো সৈকত দেখেননি। গত বছর মুগ্ধ বাবা-মাকে প্রথমবারের মতো সুন্দরবনে নিয়ে গিয়েছিল। তাই, এবার আমি বাবা-মাকে কক্সবাজারে নিয়ে যাই,’ বলেন তিনি। কিন্তু তাদের সঙ্গী হননি মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ। দীপ্ত জানান, তারা দুটি কারণে যেতে চাননি।
একটি হচ্ছে, ২০ জুলাই বন্ধুদের সঙ্গে টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার পরিকল্পনা এবং অপরটি, কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়া। ১৮ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মুগ্ধর মৃত্যুর খবর পান দীপ্ত। সেদিনই ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করলেও ফ্লাইট না থাকায় পারেননি। চলমান অস্থিরতার মাঝে সড়কপথে সময় বেশি লাগায় ১৯ জুলাই সকালের ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরেন তারা।
দীপ্ত বলছিলেন, ‘মুগ্ধর মৃত্যুর খবর কীভাবে যে মাকে বলব বুঝতে পারছিলাম না। মা হার্টের রোগী। এটা নিয়েও চিন্তা ছিল। প্রথমে তিনি মা-বাবাকে জানান, মুগ্ধ সামান্য আহত হয়েছেন। পরে জানান তিনি হাসপাতালে আছেন, অবস্থা সংকটাপন্ন। মুগ্ধর মৃত্যুর খবর জানার পর ভেঙে পড়েন তাদের মা। এখনও তিনি পুরোপুরি সুস্থ হননি।
দীপ্ত বলেন, ‘আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে মুগ্ধ মায়ের সবচেয়ে কাছের ছিল। তার মৃত্যুতে মায়ের পৃথিবীটাই যেন উজাড় হয়ে গেছে।’
মৃত্যু এবং প্রতিক্রিয়া:
২০২৪ সালের ১৮ জুলাই, ঢাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালীন মুগ্ধ গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পরপরই একটি ছোট ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে, যেটি পোস্ট করেছিলেন তার যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ।
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সময় সহিংসতায় বাংলাদেশ সরকারের হিসেব অনুযায়ী ১৫০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর তথ্য মতে, এ সংখ্যা প্রায় হাজার জনেরও বেশি। মুগ্ধর মৃত্যু এই আন্দোলনের সময় ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য মৃত্যুগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং এটি সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছে।
মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ ১৮ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় কোটা সংস্কারের আন্দোলনের পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হলে তার বন্ধু জাকিরুল ইসলাম তাকে ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ইমার্জেন্সি ভাবে নিয়ে গেলে চিকিৎসা শেষে ডাক্তার রুম থেকে বের হয়ে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সিং ফাইভারের শোক প্রকাশ
মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্ম ফাইভার। বুধবার (৩১ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ফাইবারের অফিসিয়াল পেজে মুগ্ধকে নিয়ে একটি পোস্ট দেয় তারা। এতে তার পেশাগত জীবনে প্ল্যাটফর্মটির সাথে সখ্যতার পাশাপাশি একজন প্রতিভাবান ব্যক্তিকে হারানোয় দুঃখ প্রকাশ করে তারা।
ফাইভার তাদের পোস্টে লেখে, ভারাক্রান্ত মনে আমরা জানাচ্ছি যে, আমাদের ফাইভার পরিবারের মুগ্ধ আর নেই। বাবা-মা ও দুই ভাইকে রেখে গত সপ্তাহে মারা যান মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। তিনি একজন প্রতিভাবান মার্কেটার ছিলেন যিনি এস ইও এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে তার দক্ষতার মাধ্যমে ফাইভারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন আগ্রহী ভ্রমণপিপাসু, প্রতিভাবান ফুটবলার, স্কাউট এবং একজন সত্যিকারের মানবতাবাদী। আমরা তাকে মিস করবো। তার পরিবার এবং বন্ধুদের জন্য প্রার্থনা।
শহীদ মীর মুগ্ধ চত্বর ও ফ্লাইওভার
খুলনার শিববাড়ি মোড়ের নাম ‘শহীদ মীর মুগ্ধ চত্বর’ ঘোষণা আন্দোলনকারীদের। ইতোপূর্বে শিববাড়ি মোড়ের নাম পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধুর চত্বর ঘোষণা করতে চেয়েছিল খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি)। এতে দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার জন্ম হয়। খুলনার শিববাড়ি মোড়ের নাম বদলে শহীদ মীর মুগ্ধ চত্বর ঘোষণা করেছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
শিববাড়ি মোড়ের সৌন্দর্য বর্ধক স্তম্ভের উপরে তারা এই নাম ফলক জুড়ে দিয়ে নাম পরিবর্তনের ঘোষণা দেন। আন্দোলনকারী ও সুশীল সমাজ ও হিন্দু ধর্মলম্বীদের ব্যাপক চাপের মুখে নাম পরিবর্তন থেকে সরে দাঁড়ায় কেসিসি । তাকে স্বরণ রাখতেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ফ্লাইওভারেরও নাম দেওয়া হয়েছে “শহিদ মীর মুগ্ধ ফ্লাইওভার”।
-লেখক: সাজিদুর রহমান