Newsখোলা কলাম

কারফিউ বনাম ১৪৪ ধারা

কারফিউ বনাম ১৪৪ ধারার ইতিকথা

কারফিউ সমাজের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা রক্ষার একটি প্রাচীন পদ্ধতি যা আজও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য হয়। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে কারফিউ বিভিন্ন কারণে জারি করা হয়েছে যেমন :- জননিরাপত্তা, রাজনীতি,দেশরক্ষা, স্বাস্থ্যসংকট ইত্যাদি বহু কারণে। আসুন আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জেনে নেই।

কারফিউ ১৪৪ ধারা জরুরি অবস্থা”র পরিচয় :

এই শব্দগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ খুব কমই পরিচিত। অনেকেইএগুলোর পার্থক্য বোঝেনা বা জানেনা। অনেকে মনে করেন কারফিউ, ১৪৪ ধারা, জরুরি অবস্থা সমার্থক শব্দ। অথচ আভিধানিকভাবে সেটা সঠিক ধারণা নয়।

কারফিউ শব্দটির উৎপত্তি ফরাসি শব্দ ‘couvre-feu’ থেকে, যার অর্থ ‘আগুন নিভিয়ে ফেলা’। মধ্যযুগে বিশেষ করে ইউরোপে রাতের বেলা শহরের সব আগুন নিভিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হতো যাতে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমে যায়।
এর মাধ্যমে জনসাধারণকে ঘরে থাকতে উদ্বুদ্ধ করা হতো এবং শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হতো। কারফিউর অপর নাম সান্ধ্য আইন। এটা এমন একটা আইন যেটা কোনও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিশেষ কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়। সোজা কথায় কারফিউ বা সান্ধ্য আইন হলো সন্ধ্যা কিংবা সন্ধ্যার পর নাগরিকদের চলাফেরার ক্ষেত্রে বিশেষ নিয়মকানুন।

বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদনে কারফিউ শব্দটির উৎপত্তির কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, কারফিউ বা সান্ধ্য আইন শব্দটি ইংরেজি হলেও প্রকৃত অর্থে সেটা ফরাসি ভাষার শব্দ couvre-feu (ক্যুভর-ফ্যু) থেকে এসেছে। couvre-feu (ক্যুভর-ফ্যু) শব্দের অর্থ অগ্নি নিবার্পণ বা ঘরের প্রদীপ নেভানোর হুকুম।

উইলিয়াম দি কনকরার বলেছেন:- শব্দটির প্রকৃত অর্থ হলো, “কাঠের বাড়ি-ঘরে জ্বালানো অগ্নিশিখা ও আগুনের প্রদীপ থেকে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধের জন্য রাত আটটার ঘণ্টা বাজার মধ্যেই সব আগ্নিশিখা ও আগুনের প্রদীপ নিভিয়ে ফেলার নিয়ম।”

অক্সফোর্ডের অভিধানে এর অর্থ বলা হয়েছে যে,কোনও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোনও স্থানের জনসাধারণকে ঘরে থাকার নির্দেশনা।

কারফিউ কেন দেওয়া হয়?

আধুনিক সময়ে কারফিউ বা সান্ধ্য আইন জারি করা হয় সবাইকে বাড়ির অভ্যন্তরে থাকার জন্য। এই কারফিউ দেওয়ার কারণ হলো ঘরের বাইরে জমায়েত হয়ে কোনও সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী আবার কোনও অশান্তি বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে।

২৬ জুলাই দ্য রিপোর্ট ডট লাইভে প্রকাশ হওয়া ওই প্রতিবেদনে কারফিউ বা সান্ধ্য আইনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, জনগণের প্রবেশাধিকার রয়েছে এমন কোনও স্থানে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ৪ জনের বেশি মানুষকে একত্রে জমায়েত হওয়া থেকে বিরত রাখতে সান্ধ্য আইন বা কারফিউ জারি করা হয়। সান্ধ্য আইন অনুযায়ী কোনও কোনও জায়গায় রাতে আবার কোনও জায়গায় দিনে কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করা হয়। কখনও কখনও অল্প সময়ের ব্যাবধানে কারফিউ প্রত্যাহার কিংবা শিথিল করা হয় যাতে মানুষ নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী কেনাবেচা, ব্যবসায়িক লেনদেন বা যাতায়াত সম্পন্ন করতে পারে।

১৪৪ ধারার পরিচয়

১৪৪ ধারা হলো ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির একটি ধারা। এই ধারা আইনের ক্ষমতাবলে কোনও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কোনও এলাকায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সভা-সমাবেশ, আগ্নেয়াস্ত্র বহনসহ যেকোনও কাজ নিষিদ্ধ করতে পারেন। জরুরি অবস্থা বা সম্ভাব্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এই আইনের প্রয়োগ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারায় প্রাপ্ত আইনি ক্ষমতার অপপ্রয়োগও করা হয়ে থাকে। ১৯৫২ সালে যখন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী পূর্ব বাংলার বাঙালির ওপর উর্দু চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল।

কিন্তু এদেশের তদানীন্তন ছাত্র-জনতা সেটা মানতে চায়নি। বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতা পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর জারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা মেডিকেলের সামনে মিছিল নিয়ে যায়। পুলিশ ওই মিছিলে গুলি চালালে সালাম-বরকত-রফিক-শফিক-বরকত-অহিউল্লাহ সহ আরও অনেকে শহীদ হন।

১৪৪ ধারা ও কারফিউয়ের পার্থক্য :

১৪৪ ধারা ও কারফিউয়ের মধ্যে সুক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। ১৪৪ ধারা হলো ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির একটি ধারা। এই আইনের ক্ষমতাবলে কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কোনও এলাকায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সভা-সমাবেশ করা, আগ্নেয়াস্ত্র বহনসহ যেকোনও কাজ নিষিদ্ধ করার এখতিয়ার রাখেন।

অন্যদিকে কারফিউ বা সান্ধ্য আইন হলো সন্ধ্যা কিংবা সন্ধ্যার পর বা দিনে নাগরিকদের চলাফেরার ক্ষেত্রে বিশেষ নিয়মকানুন। যাতে ঘরের বাইরে জমায়েত হয়ে কোনও সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী আবার কোনও অশান্তি বা বিশৃঙ্খলা করতে না পারে।

জরুরি অবস্থার পরিচয়

জরুরি অবস্থা হচ্ছে এমন পরিস্থিতি যা স্বাস্থ্য, জীবন, সম্পত্তি বা পরিবেশের তাৎক্ষণিক ঝুঁকি তৈরি করে। বেশির ভাগ জরুরি অবস্থায় ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধে দ্রুত হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়। যদিও কিছু পরিস্থিতিতে ক্ষতি প্রতিরোধ করা সম্ভব নাও হতে পারে। তবে পরবর্তীতে শুধু উপশমকারী সেবা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে ২০০৭ সালে এক-এগারোর শুরুতে ও ২০২৩ সালে তাপমাত্রাজনিত কারণে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। বিশিষ্টজনদের মতে, জরুরি অবস্থা জারির জন্য তিনটি শর্ত রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে যেকোনও একটি ঘটনা ঘটলে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়।

১:—–জীবন, স্বাস্থ্য, সম্পত্তি বা পরিবেশের ওপর তাৎক্ষণিক হুমকি এলে।
২:—–প্রাণ নাশ, স্বাস্থ্যের অবনতি, সহায়-সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বা পরিবেশের ক্ষতিসাধন হলে।
৩:—– ভয়ানক আকার ধারণ করে যদি জীবন, স্বাস্থ্য, সম্পত্তি বা পরিবেশের ক্ষতির বিস্তর সম্ভাবনা থাকে।

নিকট অতীতে জরুরি অবস্থার উদাহরণ

জনজীবনে বিশৃঙ্খলা এড়ানোর জন্য কখনও কখনও কারফিউ বা সান্ধ্য আইন জারি করা হয়ে থাকে। কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলে বা এলাকায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে জারি হয় ১৪৪ ধারা। আর কোথাও জরুরি অবস্থায় প্রাণ নাশ এবং স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে বাংলাদেশে বহুবার কারফিউ, ১৪৪ ধারা ও জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। তুমুল রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশে নাশকতা ও সহিংসতা চরম আকার ধারণ করে, তখনই জারি করা হয়েছে কারফিউ, ১৪৪ ধারা ও জরুরি অবস্থা।

১:—- বাংলাদেশের নিকট অতীতের জরুরি অবস্থা জারির একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা বেশ ভালোভাবে আপনি বুঝতে পারবেন। ২০০৭ সালে ফখরুদ্দিন-মঈন আহমেদের জারি করা জরুরি অবস্থা। ২০০৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন সেনাপ্রধান মঈন আহমেদের নেতৃত্বে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার যাত্রা শুরু করে। অস্থিতিশীলতা থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য মঈন আহমেদ ও ফখরউদ্দিন আহমেদের সেই সরকার শুরুতেই জরুরি অবস্থা জারি করেন। এ ছাড়া ফখরউদ্দিন-মঈন আহমেদের শাসনামলে একাধিকবার ‘স্থিতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে’ কারফিউ বা সান্ধ্য আইন ও ১৪৪ ধারা জারি এবং জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল।

বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সময়ে কারফিউ জারি করার ইতিকথা

মধ্যযুগীয় ইউরোপে কারফিউর প্রচলন বেশ ব্যাপক ছিল। ব্রিটেনের রাজা উইলিয়াম দ্য কনকোয়ারর তাঁর শাসনামলে কারফিউ জারি করেন। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে প্রতি রাতেই নির্দিষ্ট সময়ে ঘণ্টা বাজানো হতো এবং এই সময়ে সবাইকে ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য করা হতো। উইলিয়াম দ্য কনকোয়ার এই পদক্ষেপ জননিরাপত্তা রক্ষার জন্যই ছিল, তবে এটি মানুষের ক্ষোভ দমনের একটি কৌশলও ছিল।

যুদ্ধকালীন কারফিউ

বিশ্বযুদ্ধের সময়, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কারফিউ ছিল একটি প্রচলিত ব্যবস্থা। লন্ডন শহরে, রাতের বেলা শত্রুর বিমান হামলা থেকে বাঁচার জন্য আলোকসজ্জা বন্ধ রাখা হতো এবং কারফিউ জারি করা হতো। এই কারফিউ জনসাধারণের জীবন রক্ষা করতে এবং শত্রুর চোখে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে সাহায্য করত।
“‘আমরা জানতাম, কারফিউর সময় আমাদের বাঁচতে হলে অন্ধকারেই থাকতে হবে,’ উল্লেখ করেছিলেন সেই সময়ের একজন লন্ডনের বাসিন্দা।

আধুনিক যুগে কারফিউ

আধুনিক যুগে কারফিউ বিভিন্ন কারণে জারি করা হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মহামারির সময় কারফিউ একটি সাধারণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালে কভিড-১৯ মহামারির সময় বিশ্বের অনেক দেশে কারফিউ জারি করা হয়েছিল জনসাধারণের সুরক্ষার জন্য। কভিড-১৯ মহামারিকালে কারফিউ ২০২০ সালে, কভিড-১৯ মহামারির সময় অনেক দেশে কারফিউ জারি করা হয়।
ইতালি, স্পেন, ভারতসহ অনেক দেশ এই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে জনসাধারণের চলাচল সীমিত করতে। কারফিউ মানুষকে একত্রে থাকার সময় দিয়েছে, কিন্তু এর মানসিক চাপ অনেক বেশি ছিল, বলেছিলেন অনেক ইতালীয় নাগরিক।

কারফিউর ফলে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া :

কারফিউর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব উল্লেখযোগ্য। জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে কারফিউ জনসাধারণের মানসিক স্বাস্থ্যেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে, দীর্ঘস্থায়ী কারফিউ মানুষকে বিষণ্ণ ও উদ্বিগ্ন করে তোলে। কারফিউ একটি প্রচলিত সামাজিক নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি, যা বহু শতাব্দী ধরে সমাজে প্রয়োগ হয়ে আসছে। যদিও এটি কখনো কখনো জনসাধারণের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় হতে পারে, এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। সম্প্রতি কোটা আন্দোলন চলাকালীন সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ জুলাই মধ্যরাতে দেশ জুড়ে কারফিউ জারি করা হয়। পরবর্তী সময়ে আবার শিথীল করা হয়।

-লেখক: সাহিদুর রহমান

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button